• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সারা দেশ

কুষ্টিয়ায় বোরো চাল সংগ্রহে অনিয়মের অভিযোগ

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আকরামুজ্জামান আরিফ, কুষ্টিয়া:

কুষ্টিয়ায় বোরো মৌসুমে সরকারি চাল কেনায় নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। খাদ্য অফিসকে ‘ম্যানেজ’ করে রেশন, জিআর ও কাবিখা প্রকল্পের চাল কিনে পালিশের পর খুদ মিশিয়ে বস্তায় ভরে গুদামে সরবরাহ করা হচ্ছে। মূলত সরকারি চাল কিনে সরকারের কাছেই বেশি দামে বিক্রি করছেন মিল মালিকরা। পুরো এ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ওমর ফারুকসহ কয়েক নেতা ও তাদের স্বজনরা।

খাদ্য অফিসকে কেজি প্রতি ৪০ পয়সা ‘কমিশন’ দিয়ে নিম্নমানের চাল জায়েজ করা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এর বাইরে ট্রাক প্রতি গুদামের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আলাদা অর্থ দিতে হয়। বিল তুলতেও গুনতে হয় অর্থ। আবার কুষ্টিয়া থেকে খুলনায় চাল পাঠাতেও অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা পকেটে ভরছেন খাদ্য অফিসের অসাধু কর্মকর্তারা।

বোরো মৌসুমে কুষ্টিয়ায় মিল মালিকদের কাছ থেকে ৬১ হাজার ৮৪৩ টন চাল সংগ্রহ করছে সরকার। প্রতি টন ৪৪ হাজার টাকা দরে ২৬৮ কোটি টাকার বেশি চাল কেনা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, কুষ্টিয়ায় চলতি বোরো মৌসুমে প্রথম পর্যায়ে ৩৮ হাজার ৪৮২ টন চাল সংগ্রহের বরাদ্দ দেয় সরকার। এগুলো সরবরাহে জেলার ১৬৫ মিল মালিক চুক্তি করেন। দ্বিতীয় দফায় ৫ হাজার ২০০ টন চাল অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব সরবরাহে দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগ নেতা ওমর ফারুক ও তাঁর ভাইদের প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি নিয়ে মিল মালিকরা অসন্তোষ প্রকাশ করলে আরও ১৮ হাজার ৭২ টন চাল বরাদ্দ দিয়ে ১২৫ মিল মালিককে সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রফিকুল আলম টুকু বলেন, ‘দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিভিন্ন দুর্যোগ, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন বাহিনী রেশন হিসেবে চাল সংগ্রহ করে। এ চাল সংগ্রহে দীর্ঘদিন নানা অনিয়ম হচ্ছে এবং এর সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই জড়িত। ফলে সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে। লাভবান হচ্ছেন কতিপয় মিল মালিক। আর ঠকছেন ভোক্তারা।’

খাদ্য অফিসের তথ্যমতে, জেলায় আটটি এলএসডি (খাদ্যগুদাম) আছে, ধারণক্ষমতা ২২ হাজার ১০০ টন। তিন দফায় ৬১ হাজার ৮৪৩ টন   চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ৬১ হাজার ২৯৫ টন। এর মধ্যে সদর উপজেলার দুটি এলএসডি জগতি ও বড় বাজারে সংগ্রহ করা হবে ৫৬ হাজার ৭০২ টন। কুষ্টিয়ায় ধারণক্ষমতা কম থাকায় খুলনায় খাদ্য বিভাগের গোডাউনে এরই মধ্যে ৪০ হাজার টনের বেশি চাল পাঠানো হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মিল মালিক জানান, যেসব মিল মালিক অতিরিক্ত বরাদ্দ পেয়েছেন, তাদের কারও গোডাউনে মোটা ধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারা মূলত বিভিন্ন জেলা থেকে রেশন, জিআর ও কাবিখার নিম্নমানের পুরাতন চাল কিনে মিলে পালিশের মাধ্যমে উজ্জ্বল করে বস্তায় ভরে গুদামে সরবরাহ করছেন।

জানা যায়, মিল মালিকরা বিভিন্ন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ৩৭-৩৮ টাকায় চাল সংগ্রহ করে পালিশে এক টাকার মতো খরচ করেন। খাদ্য অফিসের কমিশন ৪০ পয়সা থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ১ টাকা। পরিবহনসহ আনুষঙ্গিক খরচ যুক্ত করলেও কেজিতে পড়ে ৪০ টাকা। অথচ সরকারের কাছে বিক্রি করছেন ৪৪ টাকা। পালিশের কারণে চাল সুন্দর দেখা গেলেও কিছুদিন পরই নষ্ট হয়ে যায়। রান্নার পর গন্ধে ভাত খাওয়া যায় না। এ জন্য রেশনের চাল বেশির ভাগ পুলিশ, আনসার, বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্য বিক্রি করে দেন।

সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের চাল কেনেন এমন এক ব্যবসায়ী বলেন, কুষ্টিয়ায় এ ধরনের চাল কেনার জন্য কয়েকজন ব্যবসায়ী আছেন। তারা ছয়টি উপজেলা থেকে চাল কেনেন। এরপর হাত বদলে যায় মিল মালিকদের কাছে। তারা নতুন-পুরাতন, সঙ্গে খুদ মিশিয়ে পালিশ করে সরকারি গুদামে সরবরাহ করেন।

 

কুষ্টিয়া থেকে খুলনায় চাল পাঠানো নিয়ে চলতি বছর বড় অনিয়ম হয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। কুষ্টিয়ার বেশির ভাগ মিল ও চাতাল সদর উপজেলার খাজানগর ও আইলচারা এলাকায়। গত জুলাইয়ে এসব মিল থেকে নিম্নমালের চাল গুদামে না এনে খাদ্য অফিসের যোগসাজশে মিল মালিকরা ট্রাকে ভরে সরাসরি খুলনায় পাঠান। এ পর্যন্ত ৪০ হাজার টন চাল খুলনায় পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে ২০ হাজার টনই নিম্নমানের বলে সূত্র জানিয়েছে।

একাধিক মিল মালিক জানান, পুরাতন চাল ছিল গুদামে। ধানের দামও ছিল কম। মিল মালিকরা চাল পাঠাতে তড়িঘড়ি করছিলেন। নিয়ম মেনে খুলনায় চাল পাঠাতে অনেক সময় লেগে যেত। এ জন্য তারা নিয়ম ভেঙে চাল খুলনায় পাঠান। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মিল মালিক থেকে অর্থ হাতিয়েছেন খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।

জেলা চালকল মালিক সমিতির একাংশের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেছেন, অনেক কথা বলতে মানা। বুঝে নিতে হবে। অনিয়ম হচ্ছে কিনা, তা বলা সমীচীন হবে না। সংশ্লিষ্টদের উচিত খতিয়ে দেখা।

জানতে চাইলে চালকল মালিক সমিতির অপর অংশের সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ওমর ফারুক বলেন, ‘কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। নিয়ম মেনে আমি ও আমার ভাইদের প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ পেয়েছি। সরকার নির্ধারিত মানের চালই সরবরাহ করছি।’

জেলা খাদ্য কর্মকর্তা বাবুল হোসেন বলেন, ‘সরকারি নিয়ম মেনেই সবাই চাল দিচ্ছেন। অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। এরপরও অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

খাদ্য ক্রয় কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোঃ এহেতেশাম রেজা বলেন, ‘সরকার গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য কোটি কোটি টাকার চাল কিনছে। এখানে কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না। কারও সম্পৃক্ততা পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads